বিশাল বড় বৈঠকখানার মাঝখানে একটা পুরনো দিনের সোফা আর চেয়ার। পাখার হাওয়া আর সারি দিয়ে রাখা পুরনো বইয়ের গন্ধে ভরে। বিশপ লেফ্রয় রোডের এই ঠিকানাতেই রয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা যুগের গল্প। মিনিট খানেক অপেক্ষা করার পরেই এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি। সন্দীপ রায়। বিকেলের আলো কমে আসছে বাইরে। সত্যজিৎ রায়ের ঠিকানায় বসে শুরু হল সত্যজিতের গপ্পো।
প্রশ্ন: লকডাউনে প্রায় ২ বছর হল সবাই ঘরে বন্দি। ফেলুদা কেমন আছে?
সন্দীপ রায়: ফেলুদা খারাপ থাকবে কেন! অবশ্যই ভালো আছে। ভ্যাকসিনেশনও হয়ে গিয়েছে। আর ফেলুদাকে আবার পর্দায় আনার পরিকল্পনা চলছে। তবে যতক্ষণ না পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কিছুই বলা যাচ্ছে না। ফেলুদার তো একটা ঘোরাঘুরির ব্য়াপার রয়েছে। আমরা যেভাবে শ্যুটিং করি সেটা এই পরিস্থিতিতে খুব কঠিন। তাই উপযোগী গল্প খুঁজতে হবে। আমি শেষ ফেলুদা করেছি ২০১৬ সালে। ৫ বছর হয়ে গেল। আমরা প্রথমে বাবার জন্মদিনে একটা জোড়া চমকের পরিকল্পনা করেছিলাম। ভেবেছিলাম ইন্টারভ্যালের আগে একটা শঙ্কু হবে আর পরে একটা ফেলুদা। দেখা যাক সেই ভাবনাটাকে কতটা বাস্তবায়িত করা যায়।
প্রশ্ন: সিনেমার কাজ হোক বা নিছক ভ্রমণ, ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই প্রথম এতটা দীর্ঘ সময় বাড়িতে বসে। কেমন কাটল সময়টা?
সন্দীপ রায়: চারদিক থেকে এত খারাপ খবর, এত প্রিয়জনেরা চলে গেলেন.. সময়টা খুব কঠিন। আর, বন্ধুবান্ধবরা আসতে পারছেন না, বাবার গুণমুগ্ধরা আসতে পারছেন না, কথার আদান-প্রদান হচ্ছে না। এটা আমার কাছে একটা খুব বড় ক্ষতি। তবে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। লকডাউনের সময় আমি বাবার ঘরটা গোছাব বলে ঠিক করেছিলাম। মনে হয়েছিল এটাই আদর্শ সময়। সেই কাজটা করতে গিয়ে এতরকম জিনিস পাওয়া গিয়েছে.. সেটা আমার কাছে অনেক বড় পাওনা। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কিছু লেখা পেলাম কি না। বাবা যা লিখতেন সব ফরমায়েশি লেখা। নিজের জন্য কখনও কিছু লিখতেন না। সময়ও পেতেন না অবশ্য। তবে অনেক নেগেটিভ, আঁকা, চিঠি, ডায়েরি পেয়েছি। লকডাউনের অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ওইগুলো আমায় শান্তি দিয়েছিল যেন। সেইগুলো সন্দেশে প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ১৯৯৪-এ বাবার ছবিগুলোকে বাঁচানোর জন্য আমরা রায় সোশ্যাইটি করেছিলাম।
প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একাধিক ছবিতে, বিভিন্ন ভূমিকায় কাজ করেছেন। সেই কাজের শুরুটা কেমন করে হয়েছিল?
সন্দীপ রায়: আমায় প্রথমে একটা বিষয় খুব টানত, সেটা এডিটিং। ছোটবেলা থেকেই পোস্ট প্রোডাকশনের কাজটা খুব আকর্ষণীয় বলে মনে হত। তারপর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ থেকে ছবি তুলতে শুরু করলাম। ‘সীমাবদ্ধ’ থেকে বাবাকে বলি, আমি ছবি তুলব। সেই ছবিতে প্রথম স্থির চিত্রগ্রাহক হিসাবে নিমাই ঘোষের সঙ্গে আমার নাম গেল। সেটা খুব বড় একটা পাওনা ছিল। এরপর বালা সরস্বতীর ওপর একটি তথ্যচিত্রের কাজ করছিলেন উনি।
প্রশ্ন: যখন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ বা ‘হীরক রাজার দেশে’-র শ্যুটিং হয়, তখনও পদ্ধতিগত দিক থেকে শ্যুটিংয়ের এতটা উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন স্পেশাল এফেক্টেসের কাজগুলো কীভাবে হত?
সন্দীপ রায়: গুপি গাইনের সময় ভিএফএক্স বা স্পেশাল এফেক্টের খুব দরকার ছিল। হীরক রাজার দেশেতেও কিছুটা প্রয়োজন ছিল। তবে গুপি গায়েন বাঘা বায়েন করার সময় ওঁকে যতটা খাটতে দেখেছি, ততটা জীবনে দেখিনি। প্রত্যেকটা জিনিস পরিকল্পনা করে, লিখে, ভেবে দৃশ্যগুলো পরিকল্পনা করেছেন। তখন সবটাই ক্যামেরায় করতে হত। তবে মুম্বইতে রাওকো বলে একটা সংস্থা ছিল সেইসময়। তাঁদের কাজ দেখে বাবার খুব পছন্দ হয়। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এ ভূতের নাচের কিছুটা অংশের এডিটিং-এর কিছুটা এফেক্টের কাজ ওই সংস্থাটা করেছিল।
প্রশ্ন: প্রফেসার শঙ্কুকে পর্দায় এনেছিলেন আপনি। এর আগে শঙ্কু আমাদের কাছে কেবল সত্যজিতের হাতে আঁকা ছবি। পর্দায় শঙ্কুকে আনার পিছনের গল্পটা কী?
সন্দীপ রায়: বাবা ভীষণভাবে শঙ্কু করতে চেয়েছিলেন। তখন পারেননি কারণ সেই প্রযুক্তি ছিল না। ‘এলিয়েন’ নামের একটি ছবি করার কথা হয়েছিল বাবার আমেরিকার এক প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে। হলিউডেও গিয়েছিলেন উনি। কিন্তু সেখানে ওনার একটা ভীষণ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। হলিউডের সঙ্গে কাজ করাটা ওঁর ঠিক পোষালো না। এলিয়েন হল না। পরবর্তীকালে উনি বলেছিলেন, ‘শঙ্কু হলে খুব ভালো হত, কিন্তু তাহলে তো আবার সেই বাইরের সাহায্য নিতে হবে। আমি দুবার এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই না।’ এলিয়েন বাবার খুব সাধের একটা প্রোজেক্ট ছিল। যদি এলিয়েন হত, তাহলে অবশ্যই শঙ্কু হত। অনেকদিন ধরেই আমার কাছে শঙ্কুকে নিয়ে কাজ করার আবেদন আসত। কিন্তু শঙ্কুকে রুপোলি পর্দায় আনতে গেলে প্রযুক্তির প্রয়োজন। শঙ্কু করতে গেলে ইংরাজি সংলাপ থাকবে। তবে একটা পুরোপুরি ইংরাজি ছবি বানানোর ইচ্ছা আমার ছিল না। এল ডোরাডো গল্পটায় নকুড়বাবু শঙ্কুর সঙ্গে গোটা সফরটায় রয়েছেন। তাই একটা বাংলা যোগ পাওয়া যায় ক্রমাগত। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, শ্যুটিং বাদে গোটা কাজটাই হয়েছে কলকাতায়।