নেটফ্লিক্স প্লাটফর্মে সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত রে অ্যান্থোলজি সিরিজের মধ্যে যে চারটি ছবি রয়েছে, তার পরিচালক তিন জন। সৃজিত মুখার্জি, ভাসান বালা এবং অভিষেক চৌবে। এর মধ্যে সৃজিত পরিচালনা করেছেন দু’টি। সত্যজিৎ রায়ের ছোট গল্প বিপিন চৌধুরীর ‘স্মৃতিভ্রম’, ‘বহুরূপী’, ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ আর ‘স্পটলাইট’ এই চারটি গল্পেকেই আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে ফেলা হয়েছে প্রায় সবটাই। কারণ সত্যজিৎ যখন এ গল্প লেখেন সে সময়, এবং ভাবনা একেবারেই আলাদা ছিল। নতুন যুগকে ধরতে ছবিতে বিস্তর পরিবর্তণ আনা হয়েছে। ‘রে’ অ্যান্থোলজিতে গল্পগুলির নাম যথাক্রমে ‘ফরগেট মি নট’, ‘বহুরূপিয়া’, ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’ এবং ‘স্পটলাইট’।
সত্যজিৎ রায় ‘বারো’ সিরিজের গল্পগুলি লিখেছিলেন ১৯৬০ সালের আগে। আর এই ছবি যখন বানানো হচ্ছে তখন প্রায় গোটা পৃথিবীই বদলে গিয়েছে। এই সময়কালে দাঁড়িয়ে সত্যজিতের গল্পের স্বাদ না বদলে পরিবেশন করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। তবে সেই কাজ কতটা সফল হয়েছে তা বলা মুশকিল। কারণ সত্যজিতের গল্প প্রেমিরা এই পরিবর্তণ মানতে কতটা পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। যাক সেসব নেহাত তর্কের কথা।এবার আসা যাক সিরিজে। প্রথমেই দেখানো হচ্ছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ফরগেট মি নট’। এই সিরিজে অসাধারণ অভিনয় করেছেন আলি ফজল। ইপ্সিতের চরিত্র যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। ইপ্সিত কম্পিউটার ম্যান। সে কিছুই ভোলে না। আর এটাই তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। কিন্তু অহংকার এবং তাঁর যৌন জীবন তাঁকে এমন এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করায় যেখানে সে সব হারায়। এই গল্পে যৌনতার ব্যবহার যেভাবে হয়েছে, তার সঙ্গে অনেকটাই তফাত সত্যজিতের গল্প ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’-এর। তবে পরিচালক নজর কেড়েছেন, পরিচালনায়। বাহবা দিতে হয় সৃজিতকে। কিন্তু গল্পের গতি খুব দ্রুত এগিয়েছে। অনিন্দিতা এবং শ্বেতা বসু নজর কেড়েছেন। তবে গোটা সিরিজে এই গল্পই সব থেকে বেশি আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে।
দ্বিতীয় গল্প ‘বহুরূপী’ বা ‘বহুরূপীয়া’। এই গল্পে প্রধান চরিত্র কেকে মেনন। এটিও পরিচালনা করেছেন সৃজিত। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কেকে মেনন বা ইন্দ্রজিতের জীবন সত্যজিতের গল্পের থেকে আলাদা। যৌনতায় আলাদা। তবে যতটা সম্ভব গল্পের সঙ্গে সংযোগ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রস্থেটিক মেক-আপ আর্টিস্ট যখন নিজেকে ভগবান ভাবতে থাকে, এবং তারপর তাঁর জীবন যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, এ গল্প তারই। বিদিতা বাগ, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যর অভিনয় নজর কাড়ে। এখানেও পরিচালনায় সৃজিত নিজের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছেন ‘ ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’। সত্যজিতের গল্পের নাম , “‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ । চুরির রোগ আছে মুসাফিরের। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ী। ট্রেনের কামরায় মুআসাফির ও স্পোর্টস জার্নালিস্ট আসলাম বেগের কথোপকথোন। ও একটি ঘড়ি চুরি। খুশবওক্ত। সঙ্গে গজল। এ গল্প বলে দিলে অন্যায় হবে। তবে অভিষেক চৌবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর অসাধারণ দক্ষতার কথা। মনোজ বাজপেয়ী ও গিরিরাজ রাও যে কি অসম্ভব দক্ষতায় চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কুর্নিশ জানাতেই হয়। সত্যজিৎ রায় এঁদেরকে পেলে নিসন্দেহে নতুন গল্প ভেবে ফেলতেন।
সর্বশেষ স্পটলাইট। যেখানে হর্ষবর্ধণ কাপুরের সঙ্গে নজর কেড়েছেন চন্দন রায় সান্যাল। স্পটলাইট থেকে বঞ্চিত এক ‘সফল’ নায়ক এবং স্পটলাইট কেড়ে নেওয়া এক ছদ্ম আধ্যাত্মিক মহিলার টানাপড়েন নিয়েই এগোবে গল্প। মনে পড়ে যেতে পারে ‘নায়ক’ ছবির দৃশ্য। তবে অভিনয়ে ছাপিয়ে গিয়েছেন চন্দন রায় সান্যাল। পরিচালক যথেস্ট দক্ষ। কিন্তু সবশেষে বলতেই হয় এই সিরিজেত তিন পরিচালকই দারুণ কাজ করেছেন। তবে মনে সব থেকে বেশি দাগ কাটবেন অভিযেক চৌবে এবং ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’।