কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মী ছেলে’র মতো ছবি গত ৫ বছরে তৈরি হয়নি

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মী ছেলে ‘সিনেমা নিয়ে বলতে গিয়ে  বলা যায় লিঙ্গ রাজনীতির ময়াল সাপটিকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সে-বিষয়ে অজ্ঞানতা তখনও ছিল, এখনও আছে। মেয়েদের কী করে মাপতে হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তখনও ছিল, এখনও আছে।  ভারতীয় পুরুষ সমাজ যারা চারটি হাতের অধিকারী মেয়েকে ‘দেবী’ বানায়, এদিকে দু’টি হাতওয়ালা সুস্থ ও স্বাভাবিক মেয়েদের বেধড়ক মারে? আসলে, যথেষ্ট এডুকেটেড নয় বলে এই বীরপুঙ্গবরা বুঝতে পারে না যে, চার হাতের মেয়ে বাস্তবে হয় না। যদি এমন মেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞান ‘অ-স্বাভাবিক’ শিশু বলেই তাকে গণ্য করবে। ‘লক্ষ্মী ছেলে’ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আবারও বলে, জলজ্যান্ত একটি মেয়েকে ‘দেবী’ বানাতে চাওয়াও এক ধরনের  উৎপীড়ন।

সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ মনশ্চক্ষে ভেসে উঠতে পারে এটুকু শুনে। তাহলে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ কোথায় পৃথক? সংক্ষিপ্ত উত্তর: সাহসে ও সংগ্রামে। দেবীত্বের ঐশী ডালপালা কেটে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় একটি শারীরিক ত্রুটিসম্পন্ন কন্যাকে মানব-মূল্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই নাছোড় লড়াইয়ে তাঁর সহায় তিনজন জুনিয়র ডাক্তার। যারা ধর্মাধর্মের চেয়ে বেশি বোঝে মানুষের মঙ্গলাচরণ। বর্ণাশ্রমে দণ্ডিত হিন্দু সমাজের অনমনীয় স্ট্রাকচার এই সিনেমার গল্পকে পিছনে টানতে চায়। দেখায়, স্বার্থের খাতিরে উচ্চকোটির হিঁদুয়ানি সব পারে। এমনকী, ‘অস্পৃশ্য’ বলে দেগে দেওয়া জনগোষ্ঠীকে শুদ্ধিকরণের মারফতে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারে মূল সমাজে। এই ভণ্ডামি দেখে হাসি পায়।  একটি নিম্নবর্গের মেয়ের শরীরী খুঁত যে অবহেলিত হবে আর উচ্চবর্গের ষড়যন্ত্রে চালিত হয়ে টাকা রোজগারের মেশিনে পরিণত হবে, এতে আর নতুন কী।

‘লক্ষ্মী মেয়ে’ মায়াকাজল পরানো রূপক শব্দ। নিখুঁত নারী নির্মাণের ফাঁদ নয় কি? পরিচালক হিসেবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব– ‘লক্ষ্মী ছেলে’ কথাটিকে ‘মেটাফর’ নয়, বরং অন্তর্ঘাতী বারুদের মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। জুনিয়র ডাক্তার ‘অমরনাথ’ ওরফে ‘আমির হোসেন সমাজের প্রেক্ষিতে মানববোমার মতোই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক, তা বুঝতে ছবিটি দেখতে হয়।ছবিটি দেখতে হয় আরও একটি কারণে। বহু দিন পরে প্রাদেশিক বঙ্গভাষায় নির্মিত একটি সিনেমা বিষয়, প্রকরণ আর অভিনয়ের কম্বো নিয়ে ঝলমলে অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত দিতে পারল।প্রযোজক শিবপ্রসাদ – নন্দিতা  জুটিকে ধন‌্য্যবাদ। চর্বিতচর্বণ কনসেপ্টের বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখানোর জন‌্য। সব চরিত্র, চিত্রনাট্যের সঙ্গে, সামঞ্জস‌্যপূর্ণ। চূর্ণী গঙ্গোপাধ‌্যায়, প্রদীপ ভট্টাচার্য  ,অম্বরীশ ভট্টাচার্য বাবুল সুপ্রিয় ,ইন্দ্রাশিস প্রত্যেকেই মেদবর্জিত অভিনয় করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় পাওনা একমুঠো মনোরম শরৎ-রোদের মতো নবীন প্রজন্মের তিনজন জুনিয়র ডাক্তারের অভিনয়। পূরব, ঋত্বিকা, সর্বোপরি উজান  এই সিনেমার সম্পদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *