উত্তর কলকাতায় এ মাসের মাঝামাঝি মঞ্চে তারকার মেলা! আগামী ১৬ আর ১৭ আগষ্ট শুক্রবার ও শনিবার শোভাবাজার রাজবাড়ি নাটমন্দিরে বসতে চলেছে এক ঐতিহ্যমন্ডিত নাটকের আসর। তারকাখচিত ঐতিহাসিক নাট্য ‘দেবী চৌধুরাণী’র তিনটি বিশেষ শো হবে ঐ দু’দিনে নাটমন্দির প্রাঙ্গনে। আজ শুক্রবার রাজবাড়ির নাটমন্দির প্রাঙ্গণে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথা জানানো হয় আয়োজক সংস্থা ‘সুতানুটি পালা পার্বন’এর তরফে। সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন যাত্রার তিন বিশিষ্ট শিল্পী কাকলী চৌধুরী, অনল চক্রবর্তী ও রাজু বড়ুয়া। ছিলেন বাংলা থিয়েটারের দুই নামী শিল্পী সৌমিত্র মিত্র ও বিশ্বজিৎ সরকার। এঁরা সকলেই এই নাটকে অভিনয় করছেন। এই নাটকে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে এঁদের পাশাপাশি অভিনয় করছেন কলকাতা পৌরসভার মেয়র পরিষদ দেবাশিস কুমার, তিনিও উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন নাট্যকার সম্রাট মুখোপাধ্যায় এবং পরিচালক প্রান্তিক চৌধুরী। তাছাড়াও ছিলেন ন্যান্সি, সম্রাট বিশ্বাস, সায়ন ঘোষ সহ এই প্রযোজনার শিল্পীরা।
নগর কলিকাতার জন্মদিন সপ্তাহ এবং ভারতের পুণ্য স্বাধীনতাকাল পালনে এই আয়োজন। ঐতিহ্যের স্থাপনার সঙ্গে স্বাদেশিক মুক্তি পর্যন্ত ঐতিহাসিকতার যে বিস্তার তারই উদযাপন ঘটবে এই অনুষ্ঠানে। কালের এই বিস্তৃত ক্যানভাসকে ধরতেই বেছে নেওয়া হয়েছে এই স্বদেশী ভাবনার নাট্য উপস্থাপনাকে। এই দেশে স্বাদেশিকতার যিনি প্রথম সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক পুরোহিত সেই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মহৎ উপন্যাসসৃষ্টি ‘দেবী চৌধুরাণী’র মহেন্দ্র গুপ্তকৃত নাট্যরূপকে সময়োচিত আধুনিক চেহারায় সাজিয়ে মঞ্চস্থ করা হবে ঐ দুই দিন দুপুর ও সন্ধ্যায়। ১৬ আগষ্ট (শুক্রবার) দুপুর তিনটে এবং ১৭ আগষ্ট (শনিবার) দুপুর তিনটে ও সাড়ে ছ’টায় এই উপস্থাপনা মঞ্চস্থ হবে। ১৬ আগষ্টের শো’টি হবে বিশেষ আমন্ত্রণমূলক। কলকাতার বিশিষ্ট আমন্ত্রিত নাগরিকদের সামনে তা মঞ্চস্থ হবে। ১৭ তারিখের আমন্ত্রণলিপি সাধারণ দর্শকরা সংগ্রহ করতে পারবেন। এই প্রযোজনায় অংশগ্রহণ করবেন বাংলার যাত্রা ও নাট্যজগতের বিশিষ্ট শিল্পীরা। এমন বিশাল শিল্পী সমন্বয় খুব কমই হয়েছে।
‘দেবী চৌধুরাণী’র যে নাট্যরূপটি মঞ্চস্থ করা হবে তার নাট্যভিত্তিটি বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চের গৌরবোজ্জ্বল যুগের শেষ নবাব মহেন্দ্র গুপ্তের রচনা। তাকে নবরূপায়নে আধুনিক চেহারা দিয়েছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবং নাট্যকার সম্রাট মুখোপাধ্যায়। পরিচালনায় প্রান্তিক চৌধুরী। এই বছর মহেন্দ্র গুপ্তের মহাপ্রয়াণের চল্লিশ বছর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলের গর্ব ‘স্টার থিয়েটার’-এর নাট্য-কর্ণধার। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পরেই এই সাধারণ রঙ্গালয় ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়। এই প্রযোজনা তাঁর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। তাঁর কন্যা প্রয়াতা ইভা পানি গুপ্তের প্রতিও আমরা এই সুযোগে শ্রদ্ধা জানাই। মহেন্দ্র গুপ্তের জন্মশতবর্ষকালে এই দুষ্প্রাপ্য নাটকগুলি প্রকাশ করে তিনি অসীম দায়িত্বের কাজ করেছেন বাংলা নাট্যজগতে। মহেন্দ্রবাবুর জামাতা বিজন পানি ও নাতনি মালিনী দেবীর সহৃদয় সহায়তা ও পরামর্শও ভোলার নয়।
দেবাশিস কুমার জানান, “আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক বিষয়ে আকর্ষণ অনুভব করেছি। আমার পরিবারও সব রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশে থাকতে চায়। আমি অনেক নাটকই করেছি এক সময়। বর্তমানে দায়িত্বপূর্ণ পদের কাজ সামলে সময় করে উঠতে পারি না। তবে অনেকদিন পরে মঞ্চে ওঠার উত্তেজনা কাজ করেছে খুব।তাই প্রস্তাব আসতে রাজি হয়েছি।” নানাবিধ জাঁকজমকপূর্ণ এই প্রযোজনার নির্দেশক প্রান্তিক চৌধুরী বলেন, “আমার কাছে ‘দেবী চৌধুরানী’ একটা স্বপ্নের মতো। এই কাজে যাঁরা অভিনয় করছেন তাঁদের অনেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে আমার কাছে ঈশ্বরতুল্য । তাঁদের এক জায়গায় আনা হয়েছে। ফলে এই কাজ থিয়েটারের ইতিহাসে একটা স্মরণীয় জায়গা করে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
নাটকের নব-রূপায়ন সম্বন্ধে নাটককার সম্রাট মুখোপাধ্যায় বলেন, “বাঙালি বরাবরই আত্মবিস্মৃত জাতি।তাই সে আজ উদাসীন উপনিবেশের কালে ঘটে যাওয়া সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নিয়ে। যা ছিল এ দেশে মন্বন্তরের কালে উপনিবেশ বিরোধী প্রথম সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ। হয়ত এই বিদ্রোহের চরিত্রে থাকা নিম্নবর্গের সশস্ত্র উত্থানকে ভয় পেয়েছিলেন দরবারি ঐতিহাসিকরা। বরাবরই অবশ্য এমন ভয় তাঁরা পেয়ে এসেছেন। সে অষ্টাদশ শতকের সাতের দশকেই হোক বা হোক বিশ শতকের সাতের দশকে। আর সেই ভীতি ও সচেতন উপেক্ষার ভেতর দিয়েই হারিয়ে গেছে এ দেশের প্রথম নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী জয়দুর্গা চৌধুরাণী’র প্রকৃত ইতিহাস। যিনি কাল্পনিক ‘দেবী চৌধুরাণী’ হয়ে উঠেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে। সেখান থেকে মহেন্দ্র গুপ্তের নাটকে। কিন্তু অনেকখানি কল্পনার আবেগে ঢাকা পড়ে গেছে ইতিহাস। সেই ইতিহাস, সেই উপন্যাস আর সেই নাটককে এবার তাই এক মেরুতে এনে হারিয়ে যাওয়া দেবীর বৃত্তান্তকে খোঁজার জন্য এই প্রয়াস। ইতিহাস যা বলে না, নাটকের মঞ্চ চিরকাল তা বলার দায় পালন করে। আবার কখনও উপন্যাস যা বলে না, তা খুঁজতে ইতিহাসের মধ্যে পাড়ি দেয় নাটক। এখানে দুটোই ঘটছে।”
যাত্রার অন্যতম ব্যস্ত শিল্পী অনল চক্রবর্তী বলেন, “আমি আর কাকলি ২৮ বছর একসঙ্গে যাত্রায় আছি। আমাদের দুজনেরই অভিনয় জীবন শুরু থিয়েটার থেকে। কাকলির বাটানগর গান্ধার, নটসেনা। আমি একসময় থিয়েটার ইউনিটে এবং পরবর্তীতে স্টার থিয়েটার মঞ্চের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে ছিলাম। অনেক বছর পরে থিয়েটার করবো এটাই একমাত্র আকর্ষণ।” এই সময়ের যাত্রার অন্যতম সেরা চরিত্রাভিনেতা রাজু বড়ুয়া বলেন, “থিয়েটার আমার প্রথম জীবনের শিক্ষার মাধ্যম। আমি এতো দিন পর থিয়েটার করছি। ফলে খুবই উত্তেজিত। প্রান্তিক চৌধুরী এবং সম্রাট মুখোপাধ্যায় না থাকলে এমন একটা কাজ আমার করা হত না।”
প্রসঙ্গত অনল চক্রবর্তী ও রাজু বড়ুয়া, এই প্রযোজনার দুই প্রধান শিল্পীর কেরিয়ারের সূচনায় শিক্ষক হিসেবে তাঁরা পেয়েছিলেন মহেন্দ্র গুপ্তকে। টেক-হক সলিউশনের কর্ণধার সম্রাট বিশ্বাস বলেন, “এটি একটি মহতি উদ্যোগ, যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা তাঁদের সৃষ্টির ছাপ রেখে যাচ্ছেন। সেই উদ্যোগের সাথে থাকতে পেরে টেক-হক সলিউশন এবং আমি নিজেও গর্ব অনুভব করছি। আমরা এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরানো কলকাতার সাথে এই সময়ের কলকাতাকে মেলানোর একটা কাজ করতে চাইছি।”
নাটকটি নির্মাণ করেছে টেক হক সলিউশন। নির্মাণ সহযোগিতায় ব্যারাকপুর ব্রাত্যজন। এই আয়োজনের অনুষ্ঠান সহায়ক ‘বৌ রাণী’ সংস্থা। প্রসঙ্গত একসময় এই নাটমন্দির প্রাঙ্গনেই নট্ট কোম্পানিসহ বহু যাত্রাদল তাদের প্রথম রজনীর পালাটি ‘খুলত’। ১৯৬১ সালে প্রথম যাত্রা সম্মেলনও আয়োজিত হয়েছিল এখানে। এবার সেই প্রাঙ্গনে আয়োজিত হচ্ছে ঐতিহাসিক নাটকের আসরও। উত্তর কলকাতায় হাতিবাগান পাড়ায় থিয়েটারের সূর্য অস্ত যাবার পরে, এ যেন নাট্য মহলের এক নতুন ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা।