তিনি বাংলার আবেগ, মহানায়িকা হিসেবে আজও প্রতিটি মানুষের চিলেকোঠায় বিরাজমান তিনি। তবে বেঁচে থাকলে এবারে ৯১ বছরে পা রাখতেন সুচিত্রা সেন । বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তির জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল টিম পূর্বউত্তরের তরফ থেকে। চলুন তাহলে এই কিংবদন্তির জন্মদিন উপলক্ষে আমরা একটু অতীতে ফিরে যাই। তবে প্রথমেই বলি সুচিত্রা কিন্তু আগে সুচিত্রা সেন ছিলেন না। ১৯৫১ সালে পরিচালক সুকুমার রায় যখন এই অভিনেত্রীকে সবার সামনে নিয়ে এলেন তখন তার নাম ছিল রমা সেন। এবিষয়ে পরিচালক সুকুমার রায় একবার বলেছিলেন, ১৯৫১ সালে সাত নম্বর কয়েদী ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। এমন সময় অসিত চৌধুরী আমাকে বললেন, একটি ভালো শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে আছে। মনে হয় সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে খুব নাম করবে। তার কথায় মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। প্রথম দিন ওর স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে এসেছিল দেখা করতে অরোরা স্টুডিওতে। দেখলাম, ছিপছিপে চেহারায় ডাগর ধরনের ওর চোখ। চোখ দুটি বড় সুন্দর আর খুব এক্সপ্রেসিভ। চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা। মিস্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উচ্ছলতায় ভরে যায়। এক নজরেই পছন্দ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কথার মধ্যে একটু বাঙাল টোন আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিতে রাজি হয়ে গেলাম। তবে সাত নম্বর কয়েদী ছবিতে অভিনয় করার পর সুচিত্রা সেন পিনাকী মুখার্জি পরিচালিত সংকেত ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও তিনি সুচিত্রা সেন নামে পরিচিত হননি। এর পরের ছবি অর্থাৎ নীরেন লাহিড়ীর কাজরী ছবির মাধ্যমে ১৯৫২ সালে রমা সেন পাল্টিয়ে সুচিত্রা সেন নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
বস্তুত সুচিত্রার জীবনের প্রথম হিট সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতেই প্রথম দেখা মেলে বাংলা চলচ্চিত্রের চির রোমান্টিক এই জুটির। উত্তম কুমার ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চ্যাটার্জীর সহ বেশ কিছু নায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে অসাধারণ কিছু ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। সেইসাথে দেবী চৌধুরানী ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের স্ত্রী হিসেবেও অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন। শাপ মোচন, হারানো সুর, পথে হল দেরি, ইন্দ্রাণী, সপ্তপদী, গৃহদাহ, হার মানা হার, হসপিটাল, সাত পাকে বাঁধা, সাগরিকা, দত্তা প্রভৃতি সিনেমায় সুচিত্রা সেন তার অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন। পাশাপাশি ১৯৫৫ তে দেবদাস সিনেমায় দিলীপ কুমারের বিপরীতে পার্বতীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ ছবিতে সুচিত্রা সেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। এবং ১৯৬৩ তে প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসাবে সপ্তপদীর জন্য পান মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। সুচিত্রা সেন অভিনীত শেষ ছবি প্রণয় পাশা মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। ওই বছরই তিনি সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে চিরতরে অবসরগ্রহণ করেন। অনেকেই বলে থাকেন, উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরই প্রিয় মানুষটিকে হারানোর অভিমানে চলচ্চিত্র ত্যাগ করেন তিনি। উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা গেলে সেই রাতে এসেছিলেন একখানি মালা হাতে নিয়ে। মহানায়কের দেহের ওপর মালা রেখে সুচিত্রা সেন ফিরে এসেছিলেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে, তারপর তিনি মিডিয়ার সঙ্গে আর কথা বললেন না। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে থাকেন। এরপর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি দেন সুচিত্রা সেন।
উল্লেখ্য, অবিভক্ত ভারতের বাংলাদেশের পাবনা জেলাতে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। পাবনা শহরেই ছিল তার শিক্ষাজীবন। এছাড়াও তার আরো একটি পরিচয় হচ্ছে তিনি কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী। ১৯৪৭ সালে বর্ধিষ্ণু শিল্পপতি পরিবারের সন্তান দিবানাথ সেনকে বিয়ের সূত্রে কলকাতায় আসেন পাবনার রমা। বিয়ের পরে ১৯৫২ সালে শেষ কথায় রূপালি পর্দায় নায়িকার ভূমিকায় প্রথম আত্মপ্রকাশ তার। পাবনার রমার নাম বদলে হয় সুচিত্রা। আর তার পরেরটা শুধুই ইতিহাস। তার হাত ধরেই বদলে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকার সংজ্ঞা।
সুচিত্রার চাহনি, কটাক্ষ, হাসি অভিনয় প্রতিভায় মগ্ন হয়েছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতা। এই সময় তৈরি হয় অবিস্মরণীয় উত্তম-সুচিত্রা জুটি। মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে উপহার দিয়েছিলেন একের পর এক সুপারহিট ছবি।
বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে হিন্দি ছবির জগতেও সুচিত্রা করেছিলেন বেশ কিছু অসাধারণ সিনেমা। এরপর ‘মমতা’ এবং ‘আঁধি’ সিনেমার জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের মাধ্যমে সুচিত্রার অভিনয় প্রতিভার প্রতি কুর্ণিশ জানিয়েছিল বলিউড।
এখানেই শেষ নয়। সুচিত্রাই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পান।
১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকেও সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবি মুক্তি পেয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পরও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন, যেমন হিন্দি ছবি আন্ধি। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বলা হয় যে চরিত্রটির প্রেরণা এসেছে ইন্দিরা গান্ধী থেকে।
তার নায়ক উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা গেলে সেই রাতে এসেছিলেন একখানি মালা হাতে নিয়ে। মহানায়কের দেহের ওপর মালা রেখে সুচিত্রা সেন ফিরে এলেন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে, তারপর তিনি মিডিয়ার সঙ্গে আর কথা বললেন না। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন। ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে অসুস্থ হয়ে কিংবদন্তি আরেক নায়িকা কানন দেবী যখন হাসপাতালে, তাকেও তিনি দেখতে গিয়েছিলেন।
এমনকি ২০০৫ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার নিতেও যাননি তিনি। ২০১২ সালে বঙ্গ বিভূষণ পুরস্কার পান। তার হয়ে কন্যা মুনমুন সেন এই পুরস্কার গ্রহণ করেন।
সুচিত্রা ছিলেন এক কন্যার জননী। সেই কন্যা মুনমুনও একজন গুণী অভিনেত্রী। সুচিত্রার দুই নাতনী রিয়া ও রাইমা সেনও নানীর মতোই অভিনয়কেই ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বাংলা ছবির মহানায়িকা কিংবদন্তি এই অভিনেত্রীর অমর আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।